আমন ধানের ঘ্রাণে মাতোয়ারা কৃষকরা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আমন ধানের ঘ্রাণে মাতোয়ারা শেরপুরের কৃষক। আমন কাটা-মাড়াইয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। নতুন ধান ওঠায় ধান-চালের বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। বাজারে নতুন ধান ওঠায় চালের দাম বস্তা প্রতি কমেছে ২০০/২৫০ টাকা। একই সঙ্গে আগাম জাতের আমন ধান কৃষকদের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। মাত্র ১১০ থেকে ১১৫ দিনে ফসল ঘরে তুলতে পেরে কৃষকরাও দারুণ খুশি। ফলনও হয়েছে বেশ ভালো।

সরেজমিনে শেরপুর সদর, নকলা ও নালিতাবাড়ী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্রি উদ্ভাবিত আগাম জাতের ব্রি ধান-৭১, ব্রি ধান-৭৫, ব্রি ধান-৪৯ এবং বিনা উদ্ভাবিত বিনাধান-৭, বিনাধান-১১ ধান আরও দুই সপ্তাহ আগেই কৃষকরা ঘরে তুলেছেন। আমন মৌসুমে কৃষকদের মাঝে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে এসব আগাম জাতের ধান। কৃষকরা বলছেন, নতুন জাতের এসব ধানে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ কম। সার-সেচ খরচও অনেক কম। স্বল্প জীবনকালের এসব ধান রোপনের ১১০-১১৫ দিনের মধ্যেই ফসল কেটে ঘরে তোলা যায়। আগাম জাতের এসব ধান কাটার পর একই জমিতে আবার আলু-সরিষা চাষ করতে সুবিধা হয়। আলু/সরিষা তোলার পর সেই জমিতেই আবার বোরো রোপন করবেন বলেও জানান তারা।

আমন এবং বোরোর মধ্যবর্তী আরেকটি ফসল করতে পারায় কৃষকরা অধিক লাভবান হওয়ার আশা করছেন। তাছাড়া আগাম ফসল ঘরে তোলায় বাজারে দামও ভালো পাচ্ছেন। ধানের দামে খড় বিক্রি করতে পারায় দ্বিগুণ লাভ হচ্ছে বলেও জানান তারা।

Image result for ধান চাষের ছবি

নালিতাবাড়ীর রসাইতলা গারোপাড়া গ্রামের কৃষক প্রফুল্ল রিচিল (৫৪) বলেন, ‌‌‌‘অন্য সবার জমিতে যখন ধান কেবল পাকতেছে, তখন দুই সপ্তাহ আগেই আমি ১ একর জমির আবাদ (বিনাধান-১১) ঘরে তুলেছি। মাত্র ১১০ দিনেই ধান কাটতে পেরেছি। একরে ফলন হয়েছে ৪৪ মণ।’

একই গ্রামের আরেক কৃষক এমএন রিচিল (৪৭) জানান, তিনিও এক একর জমিতে লাগানো বিনাধান-৭ ধান দুই সপ্তাহ আগে কেটে ঘরে তুলেছেন। শুকনা অবস্থায় ফলন হয়েছে ৪২ মণ। এখন তিনি সেই জমিতে সরিষা বুনছেন। সরিষা তোলার পর বোরো আবাদ করবেন।

নকলা উপজেলার কায়দা গ্রামের কৃষক আবু হানিফা (৫৮) জানান, তিনি ২ বিঘা জমিতে ব্রি ধান-৭৫ কেটে ফলন পেয়েছেন ৩৪ মণ। এই ধান একটু চিকন, চাল লম্বা হয়। প্রতি মণ ধান বাজারে ধান বিক্রি করেছেন এক হাজার ৫০ টাকা দরে। আর ধানের আঁটি (খড়) বিক্রি করেছেন সাড়ে ৮০০ টাকা মণ দরে।

তিনি বলেন, ‘আগাম ধান হওয়ায় আমি বাজারে ভালা দাম পাইছি। আর খড়ও ভালা দামে বিক্রি করে ভালা লাভ হয়েছে। এখন আমি ওই জমিতে সরিষা বুনছি। অনেকেই এখন আমার কাছে এই ধানের বীজ চাইছে।’

আরেক কৃষক মারফত আলী (৫৫) জানান, এক বিঘা জমিতে আবাদ করা ব্রি ধান-৭১ কেটে ১৮ মণ ফলন পেয়েছেন। গত বছর এই জমিতেই হরি ধান করে ফলন পেয়েছিলেন মাত্র ১২ মণ। এখন এলাকার অন্যান্য কৃষকরা ব্রি ধান-৭১ এর ফলন দেখে তার নিকট বীজ এবং চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইছেন।

শেরপুর জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রৌশন বলেন, ‘নতুন আমন ধান বাজারে ওঠায় চালের বাজারে প্রভাব পড়েছে। চাতালগুলোও সচল হয়ে ওঠেছে। গত ১০ দিনের তুলনায় চালের দাম জাত ভেদে বস্তাপ্রতি ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা করে কমেছে।’

জেলার কৃষি সম্প্রসারাণ অধিদফতর উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘জেলায় এবার ৮৯ হাজার ৪৩০ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ হয়েছে। তন্মধ্যে স্বল্প জীবনকালের আগাম উচ্চ ফলনশীল বিশেষ করে ব্রি ও বিনা উদ্ভাবিত জাত সমুহের আবাদ হয়েছে ৪৫ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে এবং হাইব্রিড জাতের আবাদ হয়েছে ১৫ হাজার ১০ হেক্টর জমিতে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এবার আমন ব্রি ধান-৪৯, ব্রি ধান-৭১, ব্রি ধান-৭৫, বিনাধান-৭, বিনাধান-১১ কৃষকদের মাঝে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কৃষকরা আগাম এবং উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠছে।

Related image

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) মহাপরিচালক ড. শাহজাহান কবীর বলেন, ‘খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। জমি কমছে, মানুষ বাড়ছে। তার উপর প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এ জন্য খরা, বন্যা, লবণাক্ত সহিষ্ণু ধান উৎপাদনের পর এবার ঠান্ডা সহিষ্ণু ধান উদ্ভাবনেও কাজ চলছে। প্রতি বছর আমাদেরকে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন লক্ষ মেট্রিক টন অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। এ জন্যই একই জমিতে জীবনকাল কমিয়ে কিভাবে অধিক ফসল উৎপাদন করা যায়, কৃষি বিজ্ঞানীরা সে চেষ্টাই করে যাচ্ছেন।’

তিনি জানান, ‘ব্রি ধান-৭১ ও ব্রি ধান-৭৫ গত বছর মাত্র অবমুক্ত করা হয়েছে। কিছুটা উঁচু জমিতে এসব ধান চাষ করা হয়। স্বল্প জীবনকালীন হলেও ফলন কম হচ্ছে না। হেক্টরে গড় ফলন ৫-৫.৫ মেট্রেক টন। ব্রি ধান-৭১ চাল মাঝারি লম্বা ও মোটা, প্রজনন পর্যায়ে এটি খরা সহনশীল। ব্রি ধান-৭৫ লম্বা, চিকন, রান্নার পর হালকা সুগন্ধ পাওয়া যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা ও খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে নতুন জাতের এ দু’টি ধান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।’

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) মহাপরিচলক ড. আমজাদ হোসেন জানান, ‘এক কেজি ধান উৎপাদন করতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। বোরো মৌসুমে ধানের আবাদ করতে পানি সেচের কারণে ভুগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এ জন্য জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় আস্তে আস্তে বোরো ফলন কমিয়ে আউশ, আমন এবং রবি শষ্যের আবাদ বাড়ানোর চেষ্টা করছে সরকার।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমন মৌসুমে বিনা উৎপাদিত বিনাধান-১১ জাতের ধান ২০ থেকে ২৫ দিন পর্যন্ত বন্যার পানি অথবা জলামগ্নতায় তলিয়ে থাকলেও ফলনের কোনো ক্ষতি হয় না। এ ছাড়া এটি আগাম জাতের ধান ১১০ থেকে ১২০ দিনে কাটা যায় এবং একরে ফলন হয় ৪০ থেকে ৫০ মণ। বন্যাসহিষ্ণু বিনাধান-১১ এসব এলাকার জন্য খুবই উপযোগী। কৃষকরা আমনের পর সরিষা বুনে পরে আবার বোরো করতে পারছে। দিন দিন বিনার এসব কৃষিপ্রযুক্তি কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর